Flight

এয়ার টার্বুলেন্স কী? কেন হয়? কোন রুট ঝুঁকিপূর্ণ?

সাম্প্রতিক সময়ে মাঝ আকাশে এয়ার টার্বুলেন্স বা বিমানে তীব্র ঝাঁকুনির ঘটনা বেড়েছে । কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট তুরস্কের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝ আকাশে এয়ার টার্বুলেন্সের শিকার হয় । বিমানের ছাঁদে আঘাত লেগে এতে কুরু সহ ১২ জন যাত্রী আহত হন । দোহা থেকে ডাবলিনগামী ফ্লাইটটি যদিও পরে নিরাপদে অবতরণ করে । এ ঘটনার মাত্র কিছু দিন আগেই ২১ মে মিয়ানমারের আকাশে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটও এয়ার টার্বুলেন্সের কবলে পরে । লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরগামী ওই ফ্লাইটে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে এক ব্রিটিশ যাত্রী মারা যান এবং আহত হন ১০০ এর বেশি যাত্রী ।

টার্বুলেন্স কী

বিমান বা উড়োজাহাজে যারা প্রায়ই চলাচল করেন তাদের জন্য এয়ার টার্বুলেন্স অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে মাঝ আকাশে যখন এয়ার টার্বুলেন্স হয় তখন তা আতঙ্কের কারণ বটে। অস্ট্রেলিয়ার সিভিল অ্যাভিয়েশন সেফটি অথরিটির মতে, যখন একটি প্লেন তুলনামূলকভাবে অস্বাভাবিক বাতাসের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এয়ার টার্বুলেন্স বা বিমানের তীব্র ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়। সহজ কথায়, টার্বুলেন্স বলতে বায়ুর অনিয়মিত প্রবাহকে বোঝায়, যা দুই বিপরীতমুখী বাতাসের সংঘর্ষের কারণে তৈরি হয়। বিপরীতমুখী বায়ু প্রবাহের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে বিমান পড়ে গেলে এয়ার টার্বুলেন্স এর সৃষ্টি হয়। এসময় বিমানে পরপর ঝাঁকুনি লাগে।

উড়োজাহাজের গতিবিধি পরিবর্তনের পাশাপাশি উপর নিচে ওঠানামা করে বিমান। এক ধাক্কায় উড়োজাহাজ কয়েক হাজার ফুট নিচেও নেমে যেতে পারে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাত, থার্মাল ফ্রন্টাল এবং মাউন্টেন ওয়েভ সহ আট ধরনের এয়ার টার্বুলেন্স এর ঘটনা ঘটতে পারে। এর মধ্যে ছয়টি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

টার্বুলেন্স কেন হয়

সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় এয়ার টার্বুলেন্সের কোনো ধরনের সংকেত বা আঝ পান না পাইলট । তাই যেকোন সময় তীব্র ঝাঁকুনির কবলে পড়তে পারে একটি বিমান । উড়োজাহাজ বিশেষজ্ঞরা  এয়ার টার্বুলেন্সের কারণ হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেঘকে দায়ী করেন । যেখানে মেঘ বেশি থাকে সেখানে ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নগামী বায়ু প্রবাহ থাকে । একদিকে গরম বাতাস উপরে ওঠে এবং অন্যদিকে ঠাণ্ডা বাতাস সেই শূন্যস্থান পুরন করে । আর বিপরীতমুখী এই দুই বাতাসের গতি ও অভিমুখ ভিন্ন হওয়ায় এলোমেলো  ভাবে বাতাস প্রবাহিত হয় । একারণেই তৈরি হয় ঘূর্ণি আর এই ঘূর্ণির কারণেইএয়ার টার্বুলেন্স ঘটে । 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে টার্বুলেন্সের ঘটনা অনেক বেশি বেড়েছে বলেই মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা । গত বছর যুক্তরাজ্যের রিডিং ইউনিভার্সিটির  বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন, সাধারণত ব্যস্ত নর্থ আটলান্টিক রুটে ১৯৭৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মারাক্তক টার্বুলেন্স ৫৫ শতাংশ বেড়েছে । একই সঙ্গে কার্বন নিঃস থেকে সৃষ্ট উষ্ণ বাতাসের কারণে অনেক উচ্চতায় বাতাসের গতির পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা । 

কোথায় সবচেয়ে বেশি  এয়ার টার্বুলেন্স হয়

সাধারণত উঁচু পর্বত, মহাসাগর, বিষুবরেখা এবং মেঘের রাজ্যের প্রবেশের সময়  এয়ার টার্বুলেন্স ঘটে । কিন্তু বাতাসের দিক পরিবর্তনের যেকোনো সময় যেকোনো যায়গায় তীব্র ঝাঁকুনির কবলে পড়তে পারে । বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দাবালনের আগুনের কারণে  এয়ার টার্বুলেন্সও হতে পারে ।  এয়ার টার্বুলেন্স শনাক্ত করার জন্য রাডার প্রযুক্তি উন্নত করা হলেও, অনেক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি থাকা সত্তেও এখন স্পষ্টভাবে  এয়ার টার্বুলেন্সের ভবিষ্যৎবানী করতে সক্ষম নন কেউই । 

কোথায় সবচেয়ে বেশি  এয়ার টার্বুলেন্স হয়

বর্ষা মৌসুমে বঙ্গোপসাগর মারাক্তকভাবে উত্তাল থাকে । তাই এসময় বিমানের টার্বুলেন্সর ঝুঁকিও অনেক বেশি । আবার আরবসের উপর দিয়ে উড়ার সময়  এয়ার টার্বুলেন্স হলেও অনেক সময় তা যাত্রীদের নজরে আসে না বলে জানান গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির গ্রিফিথ এভিয়েশনের প্রধান ডাক্তার গুইডো কারিম জুনিয়র । উচ্চ আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা টার্বুলেন্সকে আরো শক্তিশালী করে তোলে অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে  । তাই গ্রীসের সময়ে লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে উড়ে যাওয়া আর ডিসেম্বরে একই রুটে ওড়া সমান কথা নয়।

 বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এয়ার ফ্লাইট রুট কোনগুলো

এয়ার টার্বুলেন্স এর পূর্বাভাসকারী সুইডিশ সাইট Turbli র মতে ২০২৩ সালে এয়ার টার্বুলেন্স এর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুট ছিল চিলির সান্তিয়াগো থেকে ভলিভিয়ার সান্তা ক্রুজ । কাজাখস্তানের আল মাটি থেকে কিরগিস্তানের বিশকেক। চীনের লাঞ্চ থেকে চেঙ্গু । জাপানের সেন্ট্রিয়ার থেকে সেন্দা এবং ইতালির মিলান থেকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা রুট। আবার মিলান থেকে জুরিখ । এয়ার টার্বুলেন্স এ সুইজারল্যান্ড ছিল দশম স্থানে। ওয়েবসাইট অনুসারে এপ্রিলের সবচেয়ে বেশি ইয়ার টার্বুলেন্স এর কবলে পড়ে।  ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, ফিজি, পাকিস্তান, নামিবিয়া এবং উরুগুয়ে। 

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ওই মাসে উড়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উত্তাল মহাসাগর হিসেবে স্থান পায় । অস্ট্রেলিয়ার ট্রান্সপোর্ট সেফটি ব্যুরো পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক বিমানে তিন হাজার সাতশ চল্লিশটি ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৩৬ টি আবহাওয়া জনিত কারণে। আবার ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক বিমানে ৭৯০ টির মত ঘটনা ঘটেছে । যার মধ্যে আবহাওয়াজনিত ঘটনা ৫২ টি

আরো পড়ুনঃ স্ট্রোক কেন হয় ? স্ট্রোক কীভাবে প্রতিরোধ করবেন

টার্বুলেন্স কতটা বিপজ্জনক

যারা নিয়মিত বিমানে চলাচল করেন তাদের জন্য এয়ার টার্বুলেন্স অনেকটাই স্বাভাবিক। আসলে বাতাস কতটা শক্তিশালী তার ওপর নির্ভর করে ঝাঁকুনি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। টার্বুলেন্স যত ভয়াবহ হোক না কেন, তীব্র ঝাঁকুনি যেন বিমান সহ্য করতে পারে সেভাবেই উড়োজাহাজ গুলোকে বানানো হয়। তাই টার্বুলেন্স এর কারণে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মতো কোন শঙ্কা নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে টার্বুলেন্স এর কারণে যেহেতু প্রচন্ড ঝাঁকুনি তৈরি হয়, তাই বিমানের কাঠামোর সঙ্গে লেগে যাত্রীদের আহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাথায় আঘাতের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টার্বুলেন্স এ যাত্রী হতাহতের ঘটনা বিরল ব্যাপার। 

টার্বুলেন্স কতটা বিপজ্জনক

কাতার এয়ারওয়েজ এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ঘটনার মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এয়ার টার্বুলেন্স এর কবলে পড়া দুটি বিমান একই এলাকায় থাকলে হয়তো সেখানে যোগসূত্র মিলানো যেত। অর্থাৎ বিমান দুটি হওয়ায় একই আবহাওয়ায় প্রভাবিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেত। কিন্তু কাতার এয়ারওয়েজ এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট দুটি ভিন্ন সময়ে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে ছিল এবং তারা কয়েক হাজার দুরেই টার্বুলেন্স এর শিকার হয়। পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুই বিমানের টার্বুলেন্স কোনো সুস্পষ্ট বায়ুমন্ডলীয় বা আবহাওয়া সংক্রান্ত ঘটনা সম্পৃক্ত করে এমন কিছু পাওয়া যায়নি। 

টার্বুলেন্স এ করণীয় 

এয়ার টার্বুলেন্সের কবলে পড়লে যাত্রীদের বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তা হলো সিটবেল্ট ব্যবহার করা এবং কোন ভারী জিনিস বাইরে না রাখা। বিশেষত সিটবেল্ট অবশ্যই ভালোভাবে বেঁধে রাখার উপরেই জোর দেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা সিটবেল্ট যদি ভালভাবে বাঁধা না থাকে, সেক্ষেত্রে বিমানের যে কাঠামো কাঠামোর সঙ্গে মাথায় আঘাত লেগে গুরুতর আহত বা মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Exit mobile version