ইলন মাস্কের অপটিমাস রোবট কীভাবে পৃথিবী বদলে দিবে
Robot Teachnology

ইলন মাস্কের অপটিমাস রোবট কীভাবে পৃথিবী বদলে দিবে

রোবট

এক সময় মানুষ কল্পনা করত রোবট আমাদের মত হাঁটবে, কথা বলবে, মানুষের মত সকল কাজ করবে । কিন্তু এখন আর সেসব বিষয়ে মোটেও কল্পনা নয় । ইলন মাস্ক সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন । টেসলার তৈরি হিউম্যানয়েড রোবট অপটিমাস শুধু একটি যন্ত্র নয় । এটি প্রযুক্তি বিপ্লবের সম্পূর্ণ নতুন এক বিগন্ত । ইলন মাস্ক একে বলছেন সর্বকালের সেরা পণ্য এবং পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের সবাই এই রোবট একটি করে পেতে চাইবে । 

অপটিমাস রোবট পরিচিতি

ইলন মাস্ক দীর্ঘদিন থেকে মানুষের দৈনন্দিন কাজ সহজ করার উদ্দেশ্যে মানবিক রোবট তৈরি করতে চাচ্ছিলেন । ২০২১ সালের আগস্টে টেসলা এ আই ডি ইভেন্টে প্রথম অপটিমাস রোবটের ধারণা প্রকাশ করা হয় । রোবট বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে । তবে টেসলার এই রোবটটি হলো হিউম্যানয়েড রোবট । বাংলায় যাকে বলা যায় মানব সদৃশ বা মানবিক রোবট । অপটিমাস নামটি এসেছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ট্রান্সফরমার্স এর চরিত্র  অপটিমাস প্রাইম থেকে ।  সেই রোবট চরিত্রটি ছিল সাহসিকতা, ন্যায় পরায়নতা ও নেতৃত্বের প্রতিক । 

ইলন মাস্ক আশা করেন টেসলার রোবট ভবিষ্যতে হিউম্যানয়েড রোবট প্রযুক্তির নেতৃত্ব দিবে । আর সে কারণেই টেসলার এই রোবটের নাম রাখা হয়েছে অপটিমাস ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে টেসলা এ আই ডিতে অপটিমাস এর প্রথম প্রোটোটাইপ প্রদর্শিত হয় । এরপর ২০২৩ সালের আসে দ্বিতীয় প্রজন্মের অপটিমাস রোবট । অপটিমাস রোবটের একাধিক জেনারেশন রয়েছে । এবং প্রতিটি নতুন জেনারেশনে উন্নত ফিচার যুক্ত করা হচ্ছে । তবে এসব অপটিমাস রোবট এখনো বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ছাড়া হয়নি । 

দক্ষতা ও কার্যক্ষমতা

অপটিমাস মানুষের গড় উচ্চতা এবং ওজন অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়েছে । এটি অপটিমাস রোবটের উচ্চতা ৫ ফুট 8 ইঞ্চি এবং ওজন ৫৭ কেজি । এরা একসাথে ২০ কেজি পর্যন্ত ভার বহন করতে পারে । রোবটের শরীর গঠনে বায়ো মিমিক্রি ডিজাইন অনুসরণ করা হয়েছে । অর্থাৎ এগুলো মানুষের পেশী ও হাড়ের গঠন অনুসারে হালকা কিন্তু শক্তিশালীভাবে তৈরি । অপটিমাস রোবটের মস্তিষ্ক হল টেসলার ডোজো সুপার কম্পিউটারএটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শিখতে এবং কাজের ধরন অনুযায়ী নিজেকে অভিযোজিত করতে পারে । 

 ইলন মাস্ক বলেছেন আপনি যা চান অপটিমাস তার প্রায় সবই করতে পারবে । যেমনঃ 

পরিবারের শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি দেখাশোনা করা ।

 ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা ।

 বাগানের ঘাস কাটা ।

 অতিথিদের খাবার ও পানীয় পরিবেশন করার কাজ করতে পারে । 

এরা মানুষের সাথে ছোটখাটো মজার খেলা কিংবা নাচ-গান করার মত বিনোদন দিতে পারে । 

অপটিমাস রোবট
অপটিমাস রোবট আলাদা কেন হয়

অপটিমাস আলাদা কেন

বেশিরভাগ হিউম্যানয়েড রোবট দেখতে মানুষের মত হলেও কার্যক্ষমতায় অনেক পিছিয়ে । তাদের নড়াচড়া দেখেই মনে হয় কেউ হয়তো রিমোট কন্ট্রোলার দিয়ে ওগুলো চালাচ্ছে । কিন্তু টেসলার অপটিমাস এক্ষেত্রে একদমই আলাদা । অপটিমাস তার চারপাশের পরিবেশ বুঝতে পারে । পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং বাধা এড়িয়ে চলতে পারে । এবং বাধা এড়িয়ে চলতে পারে । অপটিমাস শুধু নিজে নিজে শেখে না বরং তার অভিজ্ঞতা অন্য অপটিমাস রোবটের সাথে ও শেয়ার করে । 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি অপটিমাস রোবট যদি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কৌশল শিখতে পারে তাহলে বাকি রোবটগুলো মুহূর্তের মধ্যেই তা শিখে যায় । তাই প্রত্যেকটি রোবটকে আলাদা আলাদা করে প্রশিক্ষণ দিতে হয় না । অপটিমাসের ভেতরে থাকা উন্নত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করে এরা দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে পারে । ব্যাটারির চার্জ কমে গেলে অপটিমাস নিজে নিজেই নিকটস্থ চার্জিং স্টেশন খুঁজে নেয় । তারপর সেখানে গিয়ে নিজে থেকে চার্জ নেয় এবং চার্জ পূর্ণ হলে আবার কাজে ফিরে যায় । এই বিষয়টি কারখানার মত বাণিজ্যিক উৎপাদনের পরিবেশে দারুন সুবিধাজনক । 

একটি কারখানায় দশটি অপটিমাস রোবট আছে তাহলে পাঁচটি রোবট একসাথে কাজ করবে । এবং অন্য পাঁচটি রোবট সে সময় চার্জ থাকবে । একদল কাজ করে চার্জ ফুরিয়ে গেলে চার্জে থাকা অন্য দলটি কাজে নেমে পড়বে । এভাবে রোবট এর মাধ্যমে ২৪ ঘন্টায় কারখানা সচল রাখা সম্ভব । ২০২৩ সালে টেসলা যখন দ্বিতীয় জেনারেশনের অপটিমাস দেখায় তখন তার ডিগ্রী অফ ফ্রিডম ছিল ১১ বর্তমানে তা বেড়ে ২২ এ পৌঁছেছে । ডিগ্রী অফ ফ্রিডম হলো একটি রোবট কতভাবে তার হাত বা দেহ নাড়াতে পারে তার একটি পরিমাপ । ২২ ডিগ্রি মানে রোবট ২২ টি ভিন্ন ভিন্নভাবে হাত ঘুরিয়ে কাজ করতে পারে । যার ফলে ভারী কোনো জিনিস তোলা থেকে শুরু করে ডিম ফাটানোর সূক্ষ্ম কাজ ও এরা অনায়াসে করতে পারে । 

টেসলা কেন এগিয়ে

বিশ্বের বড় বড় রোবটিক্স কোম্পানিগুলো যেখানে উন্নত মানের হিউম্যানয়েড রোবট তৈরির ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে । সেখানে টেসলার মত একটি গাড়ি উৎপাদন কারি কোম্পানি কিভাবে চমকপ্রদ এই রোবট তৈরি করল তা অনেকের কাছেই একটি বড় বিষয় । আসলে এমন গাড়ি তৈরি করে যা নিজে নিজেই চলতে পারে । আর এ জন্য তারা দুটি চমৎকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে । প্রথমটি হলো টেসলা ভিশন ও দ্বিতীয়টি হলো AI এক্সিলারেটর । টেসলার ভিশন গাড়িগুলোকে তার চারপাশের দুনিয়া দেখতে সাহায্য করে । 

রাস্তায় হাঁটার সময় আমাদের চোখ যেমন সবকিছু দেখতে পায় । ঠিক তেমনি টেসলার গাড়িগুলো তাদের চারপাশের জিনিস গুলো দেখে । আর AI এক্সিলারেটর সেসব তথ্য দ্রুততার সাথে বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয় ভাবে গাড়ি চালায় । বলতে গেলে টেসলার গাড়িগুলো এক একটি উন্নত মানের রোবট । টেসলা তাদের অপটিমাস রোবট এর মধ্যেও গাড়ির প্রধান দুটি প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়েছে । তাই তারা এত দ্রুত সময়ের মধ্যে অপটিমাস এর মত উন্নত রোবট বানাতে সক্ষম হয়েছে । 

টেসলা কেন এতো এগিয়ে আছে

ইলন মাস্ক ধারণা দিয়েছেন, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হলে একেকটি অপটিমাস রোবটের দাম হবে প্রায় ৩০ হাজার মার্কিন ডলার । বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ৩৬ লাখ টাকার সমান । তবে টেসলার অপটিমাস রোবট নিয়ে কিছুটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে । প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছেই এত কম সময়ে এতো নিখুত কাজ করার উপযোগী রোবট তৈরির বিষয়টি খানিকটা অস্বাভাবিক লেগেছে । অনেকেই ধারণা করছেন অপটিমাস রোবটগুলো প্রদর্শনের সময় সেগুলো হয়তো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল । 

আরো পড়ুনঃ ভাত খেয়ে ওজন কমাবেন কিভাবে 

অপটিমাস রোবটের ভবিষ্যৎ

অপটিমাস রোবট ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত সহকারি থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানায় কাজের ধরন বদলে দিতে পারে । এটি বিভিন্ন বিপদজনক কাজ যেমন নির্মাণশিল্প, খনির গভীরে কাজ করা অথবা মহাকাশ অভিযানে ব্যবহার করা যেতে পারে । ইলন মাস্কের মতে, ভবিষ্যতে অপটিমাস রোবট সর্বজনীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে । মাস্ক বলেছেন যে, ২০২৫ সালেই টেসলার কারখানায় ১০০০ অপটিমাস রোবট নিয়োগ করা হবে । এবং ২০২৬ সালের অন্যান্য কোম্পানির উৎপাদন ব্যবস্থায় অপটিমাস ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে । 

 উন্নত বিশ্বের শিল্প কারখানার মালিকেরা যদি মোটা অংকের বিনিয়োগ করে মানব শ্রমিকের বদলে অপটিমাস এর মত রোবট বাহিনী দিয়ে কারখানা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় । তাহলে তা চীন-ভারত বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে । কারন এশিয়ার দেশগুলোর সস্তা শ্রমের কারণে পশ্চিমারা এখান থেকে তাদের পণ্য উৎপাদন করিয়ে নেয় । কিন্তু এককালীন বিনিয়োগ করে রোবট দিয়ে দিন রাত ২৪ ঘন্টা কাজ করানো গেলে তখন আর সস্তা শ্রমের দরকার হবে না । মানব শ্রম এর বিকল্প হিসেবে রোবটিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে বিশ্ব জুড়ে ভয়াবহ বেকারত্ব তৈরি হবার সম্ভাবনা রয়েছে । 

তবে টেসলা বলছে, মানবিক রোবট প্রযুক্তি মানুষের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে । তাদের মতে রোবট শ্রমিক বেড়ে গেলে তখন রোবট ডেভলপমেন্ট, রোবট রক্ষনাবেক্ষণ এবং রোবটের AI পরিচালনার মতো নতুন নতুন নানান রকমের চাকরির সুযোগ তৈরি হবে । তবে সেসব চাকরি হবে অত্যন্ত দক্ষ ব্যক্তিদের কাজের ক্ষেত্র । তখন দেখা যাবে মাত্র ১০ জন লোক ১০০০ রোবট কর্মীর একটি কারখানা পরিচালনা করছে । সে ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষেরা ব্যাপক হারে তাদের চাকরি হারাবে । 

ইলন মাস্ক মনে করেন, অপটিমাস ভবিষ্যতে মানুষকে আর্থিক স্বাধীনতা দিতে পারে । যেখানে মানুষ শুধু সৃজনশীল কাজ করবে আর দৈনন্দিন পরিশ্রমের সকল কাজ করবে রোবট । কিন্তু অপটিমাস রোবট এখনো অতটা কার্যকর হয়ে ওঠেনি । তবে ভবিষ্যতে এই রোবট নিঃসন্দেহে আমাদের দৈনন্দিন কাজকে অনেক সহজ করে তুলবে ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।